নশ্বর এই পৃথিবীতে মানুষের চিরকালের আকাঙ্ক্ষা ছিল অমর হওয়ার। এই অমরত্ব লাভের উপায় খুঁজতে অনেকেই নিজের জীবন অতিবাহিত করেছেন। প্রাচীন যুগের যোগীদের থেকে শুরু করে আধুনিক যুগের গবেষকরা পর্যন্ত সমুদ্র, পাহাড়-পর্বত পাড়ি দিয়েছেন অমরত্ব লাভের খোঁজে। সন্ধান করেছেন অমৃত সুধা। যা পারে নিজের অস্তিত্বকে পুরো মহাজগতের সঙ্গে এক করে ফেলতে। নিয়ে যেতে পারে জাগতিক দর্শনের ঊর্ধ্বে। মানুষকে করতে পারে সর্বশক্তিধর, নিরোগ, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী এবং ধনরত্নপ্রদায়ক।
সোমলতা বা সোমরস তেমনি এক উপাদান। হাজার হাজার বছর ধরে চলছে অনুসন্ধান। গবেষণা চলছে এখনো। কারণ ধারণা করা হয় এই সোমলতা থেকে নির্গত সোমরস মানুষকে এনে দিতে পারে অমরত্ব!
সোমরস বৈদিক চিন্তার একধরনের মহাজাগতিক শক্তি। একধরনের আধ্যাত্মিক নীতি। উদ্ভিদ জগতের প্রতিরূপ হলো এই সোমরস।
মূলত সোম হলো গুল্ম বা লতা। এই লতার রস ছিল আর্য এবং প্রাগবৈদিক যুগের ঋষিদের অতি প্রিয় পানীয়। সোমরস বিন্দু বিন্দু করে ক্ষরিত হতো বলে এর নাম দেয়া হয়েছিল ইন্দু। এই রস হতে একধরনের উত্তেজক তরল প্রস্তুত হতো। প্রাচীন মুনী-ঋষিদের বিশ্বাস ছিল সোমরস পান শুধু তাদের শক্তি এবং সাহস দিবে তাই নয়; বরং এটি পান করলে ধনার্জনে পারঙ্গমতা লাভ করবে এবং বেড়ে যাবে সন্তান উৎপাদনের ক্ষমতা। সোমরস ছিল যজ্ঞের প্রধান আহুতি।
ঋগ্বেদে সমস্ত নবম মণ্ডল সোমের স্তবে পরিপূর্ণ। সোম বন্দনার সুক্ত সংখ্যা ১২০। এর বাইরে অন্য ছয়টি সুক্তে অগ্নি, ইন্দ্র, পূষা এবং রুদ্র দেবতার সঙ্গে সোমের স্তব করা হয়েছে।
পৃথিবীর অধিকাংশ প্রাচীন আখ্যানে অমরত্ব প্রদানকারী রূপে কোনো না কোনো বনস্পতির উল্লেখ তাৎপর্যপূর্ণ। এমনকি প্লিনি রচনাতেও অমরত্ব প্রদানকারী অ্যাম্ব্রোসিয়া বা অমৃত শব্দ বিভিন্ন বনস্পতির প্রতি নির্দেশক। বনস্পতির দীর্ঘকালীন জীবন, প্রাচীন মানবদের নিকট চিত্রিত হয়েছিল-বনস্পতি মরণহীন রূপের প্রতিচ্ছবিতে। মানুষ সম্ভবত এ রকম দীর্ঘজীবী বৃক্ষগুলোকে দেখে প্রথম অমরত্ব লাভের কল্পনা করতে শুরু করে।
পৃথিবীব্যাপী বিশেষ করে ইউরোপ এবং আমেরিকায় বেশকিছু পাইন ও অলিভ বৃক্ষের সন্ধান পাওয়া যায়। যেগুলোর বয়স কয়েক হাজার বছর। অদ্যাবধি প্রাপ্ত তথ্যের নিরিখে, পৃথিবীর প্রাচীনতম জীবিত প্রাণের একটি হলো স্প্রুস গোত্রের বৃক্ষ। যার অবস্থান সুইডেনে। ওল্ড টিজেআইকেকেও নামে পরিচিত। এই বৃক্ষের বয়স প্রায় ৯ হাজার ৫ শ ৫০ বছর বলে ধারণা করা হয়। গবেষণা চলছে, হতে পারে এই প্রাচীন কোনো বৃক্ষের মাঝেই লুকিয়ে আছে অমরত্বের রহস্য!
আধুনিক ধারণায় সোম আসলে শুধু একটি উদ্ভিদ নয়। যদিও একসময় নির্দিষ্ট কোনো স্থানে প্রাথমিকভাবে সোম উদ্ভিদ বা সোমলতার অস্তিত্ব ছিল বলে প্রাচীন গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে। ঋগ্বেদ অনুযায়ী বিভিন্ন বিশেষ উদ্ভিদের পরিমাণ মতো মিশ্রণেও তৈরি হয় সোমরস (ঋগ্বেদ ১০.৯৭.৭)। এ ছাড়াও ঋগ্বেদে সোমের আরো কিছু ধরনের কথাও উল্লেখ রয়েছে। যেমন, হিমালয় থেকে উৎপন্ন হিমবাহের পানি (ঋগ্বেদ ৬.৪৯.৪)। বেদ অনুসারে অগ্নি বা আগুনের প্রতিটি রূপের মধ্যেও রয়েছে সোম। এই ক্ষেত্রে মহাবিশ্বের সর্বত্রই সোমের উপস্থিতি রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। এমনকি অগ্নি এবং সোম, চীনা ‘ইন অ্যান্ড ইয়ং’ দর্শনের সমতুল্য।
প্রাচীন গ্রন্থে সোমরসের বর্ণনা অনুযায়ী, সোমরস শুভ্র-বর্ণ, ঈষৎ অম্ল ও মাদকতাজনক। যার জন্মস্থান মুজবান পর্বত কিংবা সরস্বতী নদী। বলা হয় স্বর্গ হতে শ্যানপক্ষী সোম আহরণ করে এনেছিলেন। এরপর সোমকে পর্বত হতে শকটে করে যজ্ঞ স্থানে আনা হতো। পরে পাথর বা লোহা দ্বারা ছেঁচে সোমরস নিষ্কাশন করা হতো। রস নিষ্কাশনের একটি পদ্ধতিও ছিল। দুই হাতের দশ আঙুল দিয়ে চেপে রস নিঙড়ানো হতো। পরে ‘তনা’ নামে মেষ লোম-নির্মিত ছাঁকনি দ্বারা ছেঁকে দুগ্ধ মিশ্রিত করে সোমরস পান করা হতো। এটি ছিল অমরত্ব লাভের লুকায়িত জ্ঞান। যা যুগে যুগে মানুষেরা নিজেদের ভেতর ধারণ করে এসেছিল।
আধুনিক পণ্ডিতদের মতে ‘এফেড্রা’ থেকে সোমরস তৈরি হয়। আফগানিস্তান এবং ইরানে এফেড্রা খুবই পরিচিত উদ্ভিদ। ফারসিদের কাছে এফেড্রাই ছিল সোম উদ্ভিদ। এমনটাই ধারণা করা হতো। বর্তমান যুগেও ভারতের কিছু অংশে এফেড্রার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। যা সোমলতা নামে পরিচিত। কিন্তু এর মধ্যেও কিছু মতভেদ রয়েছে। সোম নিঙড়ালে দুধের মতো রস নির্গত হয়। কিন্তু এফেড্রা শুকনো উদ্ভিদ যা থেকে সামান্য পরিমাণে রস নির্গত হয়। তাই এফেড্রা থেকে সোম রস তৈরির যুক্তি খুব বেশি গ্রহণযোগ্য নয়।
প্রাগৈতিহাসিক সময় থেকে পৃথিবীব্যাপী সোমের সন্ধান খুঁজে চলেছেন গবেষকরা। তার মধ্যে বিগত আড়াইশ বছর ধরে বিশেষভাবে আমেরিকান এবং ইউরোপিয়ানদের মধ্যে চলছে সোম রস খোঁজার চেষ্টা।
চালর্স উইন্সকিনের মতে, সোম একপ্রকার লতাজাতীয় বনস্পতি। যা যজ্ঞ অনুষ্ঠানের অন্তিম পর্যায়ে পশুবলির পর সোম রস পান করা হয়।
গ্রিক জেনারেল জেনোফেন ৪০১ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে তার গবেষণায় তিনি মধুকে সোমরস বলে ভুল করেন।
১৮৫৫ সালে ম্যাক্স মুলার একটি প্রাচীন আয়ুর্বেদিক শ্লোক উদ্ধার করে। সেই শ্লোক অনুযায়ী সোম কৃষ্ণবর্ণ, শুভ্র-বর্ণ, ঈষৎ অম্ল ও মাদকতাজনক। সোমরস নিয়ে এটিকে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে সঠিক বর্ণনা হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। এ ছাড়া ড. ওয়াল্টার রক্সবার্গ, জর্জ স্টিফেনসন, ড. ডেভিড ফ্রোলে বিভিন্ন সময় সোমলতা এবং সোমরস আবিষ্কারে নিয়োজিত ছিলেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সোমরস ‘অ্যামানাইটা মাসকারি’ মাশরুম থেকে তৈরি হয়। যার উৎপত্তি স্থল সাইবেরিয়াতে। বেদ সোমকে ভিন্নভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। যার পাতা রয়েছে। কিন্তু মাশরুমের কোনো পাতা হয় না।
এ ছাড়া অথর্ব বেদে বলা হয় (অথর্ব বেদ ১১.৬.১৫) কিছু উদ্ভিদ যেমন মারিজুয়ানা বা গাঁজা, যব অথবা দূর্বা থেকে সোম অনেক উন্নত। কিন্তু ডারভা বা দূর্বার, মারিজুয়ানার মধ্যে সোমের কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। অন্যান্য উদ্ভিদ যেগুলো সোমের সাথে সংযুক্ত সেগুলো হলো পদ্ম এবং শাপলা। সোমের মতো এই উদ্ভিদগুলো পিষলে এদের থেকেও দুধের মতো রস নির্গত হয়। সোমরস সুমিষ্ট, এই রস যেমন পানীয় হিসেবে ব্যবহৃত হতো-তেমন দুধ, দধি ও ক্ষীরে দেয়া হতো মিষ্টতার জন্য। এ কারণে হয়তো সোমকে মধুও বলা হয়ে থাকে।
আয়ুর্বেদে বিভিন্ন রোগনাশক ভেষজ ঔষধি উদ্ভিদের নাম হিসাবে সোমকে বর্ণনা করা হয়েছে। বর্তমান আয়ুর্বেদে সোম উদ্ভিদ বলতে কোনো একটি বিশেষমাত্র উদ্ভিদকে চিহ্নিত করে না। সোম উদ্ভিদ মানে উদ্ভিদগোষ্ঠীর ২৪ ধরনের ভিন্ন উদ্ভিদের সমন্বয়। সোম গোষ্ঠীর উদ্ভিদগুলোর ভেষজ গুণাগুণ সম্পর্কে বৈদিক ঋষিরা খুব ভালোভাবে পরিচিত ছিলেন।
সোমলতা মস্তিষ্কের সঙ্গে দেহের আত্মিক এক সম্পর্ক তৈরি করে- যা যোগাসন, প্রাণায়াম অথবা ধ্যান করতে সাহায্য করে।
সোমকে প্রাচীন এবং পবিত্র উদ্ভিদ হিসেবে ধরা হয়। যা আধ্যাত্মিকতা বৃদ্ধিকারী, অনুপ্রেরণাদায়ক এবং বুদ্ধিবৃত্তি উন্নয়নকারী। ধারণা করা হয় প্রতিটি সম্প্রদায়ে অথবা ভৌগলিক অঞ্চলে তাদের নিজস্ব সোমলতা রয়েছে।
আন্তর্জাতিক গবেষক এবং বিশিষ্ট চিন্তাবিদের মতে, সোম হলো ধ্যানের এমন এক পর্যায় যাওয়া- যে পর্যায়ে নিজের অস্তিত্বের সাথে পৃথিবীসহ পুরো জগৎকে এক করে ফেলা। প্রাচীন যুগের যোগীরা দীর্ঘ সাধনার মাধ্যমে এমন এক পর্যায় উপনীত হতে পারতেন, যে পর্যায়ে মস্তিষ্ক থেকে একধরনের মোমের মতো রস পুরো শরীরে নিঃসরণ করার সক্ষমতা রাখতেন। যে রস প্রতিটি কোষ-অনুকোষকে নতুনভাবে জন্ম দিতে পারত। প্রাচীন যোগীরা বারবার এই ধ্যানের মাধ্যমে দীর্ঘ জীবন লাভ করতেন। মূলত সোম থেকে সমুদ্র শব্দটি এসেছে। সোম মানে উপরে থেকে নীচে প্রবাহমান। সাধারণ মানুষকে এর মাহাত্ম্যকে উপলব্ধি করতে পারে না। প্রাচীন মুনী-ঋষিরা তাদের প্রাপ্ত বা গবেষণালব্ধ জ্ঞানকে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে হস্তান্তরের উদ্দেশ্যে সহজভাবে পূজার মাধ্যমে জ্ঞানগুলো হস্তান্তর করেছেন।